দেশে ২০১৯ সালের আগে অবস্থাটি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে পাবলিক পরীক্ষা মানেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো বা অভিযোগ উঠত! এসএসসি, এইচএসসি কিংবা জেএসসি পরীক্ষা যে পরীক্ষাই হোক না কেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসসংক্রান্ত কোনো না কোনো অভিযোগ উঠত। কখনো কখনো শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়ও এ ধরনের অভিযোগ উঠত। এ নিয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ চরম বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন। অবশ্য তাঁর মেয়াদের শেষ বছরেই অভিযোগ বন্ধ হয়েছিল। তখন নানামুখী তৎপরতায়, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং কোন সেট প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে, তা পরীক্ষা শুরুর মাত্র ২৫ মিনিট আগে জানানোসহ কিছু পদক্ষেপর কারণে তখন এ অভিযোগ বন্ধ হয়েছিল।
এরপরের তিন বছর আর এ নিয়ে অভিযোগ ওঠেনি। এর মধ্যে অবশ্য দুই বছর গেছে পুরোপুরি করোনাকাল। এ সময়ে কখনো পরীক্ষা হয়েছে, কখনো ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে এখন অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পুরোনা সমস্যাগুলো আসলে শেষ হয়ে যায়নি। এর মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা যেমন আছে, তেমনি ভুল পত্র বিতরণের কারণে পরীক্ষা স্থগিতের মতো ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া কোনো কোনো শিক্ষা বোর্ডে কোনো কোনো বিষয়ে বিতর্কিত প্রশ্ন করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
আর এসবের কারণে সমস্যায় পড়ছে পরীক্ষার্থীরা। বিদ্যমান পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এমনিতেই শিক্ষার্থীরা চাপে থাকে। এর মধ্যে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তাদের আরও চাপে ফেলে দেয়। অথচ একটি পাবলিক পরীক্ষা হয় দীর্ঘ সময় নিয়ে নানা প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে।
একটি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে যেটি বোঝা গেল, আসলে এসব ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্মর্কতাদের অদক্ষতা আর অবহেলাই দায়ী।
যেসব অভিযোগ উঠছে
অনেকটা আকস্মিকভাবে গত রোববার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসির (বিএমটি) একাদশ শ্রেণির বাংলা-১ (নতুন ও পুরোনো পাঠ্যসূচি)-এর পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এর কারণ খুঁজতে গেলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র করা হয়ে গেছে পুরোনো পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে, আর পুরোনো শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নপত্র করা হয়েছে নতুন পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে। ফলে এ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
এর মানে এখানে অদক্ষতার বিষয়টি পরিষ্কার। কারণ, নানা যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপা হয়। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণের কারণে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) অংশের পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছিল। তখন আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, নড়াইলে বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার দিন ভুলের কারণে দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ প্রশ্নপত্র চলে গিয়েছিল। এ কারণে শুধু যশোর বোর্ডের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ অংশের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীন এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এ কারণে চারটি বিষয়ের (গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষা ও রসায়ন) পরীক্ষা স্থগিত করে নতুন প্রশ্নপত্রে গ্রহণ করা হয়। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া বাকি দুই বিষয়ের (উচ্চতর গণিত ও জীববিদ্যা) পরীক্ষা নতুন প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে নির্ধারিত সময়েই নেওয়া হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি একজন কেন্দ্রসচিব, যাঁর দায়িত্ব হলো নিরাপদে প্রশ্নপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। ফলে দিনাজপুর বোর্ডের অধীন প্রায় পৌনে দুই লাখ পরীক্ষার্থীকে সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ, তাদের পরিবর্তিত সময়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে চার বিষয়ে।
এসব অভিযোগ ছাড়াও প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে অদক্ষতার অভিযোগ উঠছে। যেমন এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক বিষয়ে প্রশ্ন করার অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে আজ সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বিষয়টিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে বলেছেন, এ প্রশ্ন কোন সেট, কোন মডারেটর করেছেন, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এত প্রস্তুতির কথা বলার পরও কেন বারবার বিভিন্ন রকমের বিতর্কিত ঘটনা ঘটছে? বিতর্কমুক্ত পাবলিক পরীক্ষা আমরা কবে পাব? নাকি সেই পুরানো সমস্যাগুলোর ঘেরাটোপেই বন্দী থাকবে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের গতিপথ ঠিক করে দেওয়ার এসব পাবলিক পরীক্ষা।
এ বিষয়ে কথা হয়, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আমিরুল আলম খানের সঙ্গে। তাঁর সার কথা হলো, এখানে দুটি কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
একটি হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষতার অভাব এবং আরেকটি হলো অবহেলাজনিত। তাঁর মতে, অনেক ক্ষেত্রেই পদায়ন করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় বা তদবিরের মাধ্যমে। এ সংস্কৃতি খুবই ক্ষতি করছে। এতে যে কর্মকর্তাকে যেখানে পদায়ন করা হচ্ছে, তিনি সেখানকার জন্য যোগ্য কি না, তা দেখা হয় না। আর এর ফলে সর্বোপরি ক্ষতিটি হয় শিক্ষার্থীদের। তাঁর মতে, সবকিছুতেই দলীয়করণ বা তদবিরে পদায়ন করা ঠিক না। দক্ষ, সৎ ও যোগ্য লোকদের সঠিক জায়গায় পদায়ন করতে হবে।